top of page

ছোট গল্পঃ নয়নতারা ও ভালোবাসা

  • Writer: শময়িতা দিয়া
    শময়িতা দিয়া
  • Apr 30, 2023
  • 5 min read

বারান্দায় ফুলের টবগুলোতে পানি দিতে সীমা দেখলো সামনের পুরানো পরিত্যক্ত বাসার ভাঙা প্রাচীর এর উপর প্রকৃতির খেয়ালে জন্ম নেওয় নয়নতারা ফুলগুলো এই খরার দিনেও মলিন হয়ে গেলও একেবারে নেতিয়ে পড়ে নি।কিন্তু তার যত্নের ফুলগাছ গুলো ফুল তো আসেই না বরং নেতিয়ে কেমন হয়ে গেছে। অবশ্য তার শত চেষ্টা আর যত্নে ও কোন কিছুতেই লাভ বিশেষ হয় না, হলে তার আর মাসুমের সংসার টা টিকে যেত। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই মুঠোফোনে মায়ের ফোন আসলে মনটাকে আর গলাটাকে একটু সামলে ফোনটা রিসিভ করলো সীমা। মা ফোন করেই বললো,' দোলনের মা আর বেঁচে নেই রে'। সীমা, 'ওমা, মেজোচাচী আর নেই, বলো কি!ইন্না-লিল্লাহ' মা,'তোর মেজোচাচী আর কোথায় , তিন বছরের দোলনকে রেখে তো প্রেমিকের সাথে চম্পট দিলেন,, তবে খারাপ লাগছে শেষ সময় নিজের মেয়ের কাছে শেষ সময় একটু পানি ও পেলো না,,তবে তার ঐ পেয়ারা প্রেমিক মানে দ্বিতীয় স্বামী সবটুকু দিয়ে তার খুব করেছে '। সীমা,'হুম ক্যান্সারের সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য এমন একজন পাওয়া ভাগ্যবতীর লক্ষণ,দোলন মেয়ে টা তো একটা বার ও মায়ের মুখের সামনে দাঁড়ালো না এটা খারাপ করলো,থাক দোলনের ও তো একটা অভিমানের জায়গা আছে। মা,'আমাদের অবশ্য দোলন খবর টা দিলো,,বাদআসর মাটি হবে'। সীমা,'তাহলে তো আর তিন ঘন্টার মধ্যে মাটি হয়ে যাবে, তুমি তো যাবে, তা আমি জানি,গিয়ে একটা ভিডিও কল দিয়ো তো, একটু মুখটা দেখবো,কি সুন্দর মুখ টা ছিলো '।আজকে একেবারে গুমোট গরম, রাখছি। বলেই ফোনটা কেটে দেয় সীমা। মাসুমের সাথে সীমার দেখা হওয়াটা ও এমন একটা গুমোট দিনেই। প্রথম দেখাতেই তো মনে আলোড়ন তৈরি হয়েছিলো তো বটেই কিছুদিন ওর স্বভাব আচরণ ও ভদ্রতা দেখে রীতিমতো গভীর ভালোবেসে ফেলেছিলো সীমা। সত্যিই ভালোবাসতো ওকে। তারপর সেই ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে পরিবারের অমতে বিয়েও করেছিলো বেকার কপর্দকহীন মাসুমকে। আজকের জাঁদরেল প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাটির পেছনে কোথায় লুকিয়ে রয়েছে তার প্রেমিক পুরুষ টি। না তার পক্ষে আর সত্যি সম্ভব না। একে তো বিয়ের এতো বছর পর ও তাদের কোন সন্তান নেই,এক্ষেত্রে কি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে তাকে মাসুমের বাড়ির লোকজন বা মাসুম নিজে ও কি সীমাকে দোষারপ করে না? কথায় কথায় খিটমিটি লেগেই থাকে তাদের, আজকাল কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে মাসুম পরনারীতে আসক্ত। এটার যদি ও কোন হাতে নাতে প্রমাণ পায় নি সীমা। তবে সন্দেহটা তো থেকেই যায়। আচ্ছা আজ আসুক তারপর সে প্রথমে তাদের সেপারেশনের কথা টা উল্লেখ করবে, তারপর ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটা সে কিছু দিন পরে জানিয়ে দেবে। এই ভাবতে ভাবতেই মায়ের আবার ফোন এলো। সীমা ভিডিও কলেই তার এক সময়ের মেজোচাচীর সুন্দর নিথর মুখটা দেখে নিলো সীমা কিন্তু বড় একটা দুঃখ অনুভব করতে পারলো না সে। যদিও তার শৈশবের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে তার এই মেজো চাচী।সে যতদিন তাদের সাথে থেকেছে ভালোবাসা দিয়েছে ,স্নেহ দিয়েছে,সেবা করেছে।সত্যি বলতে কি তার মেজো চাচীর মতো মসৃণ মোমের পুতুলের মতো গড়নের কখনো কাউকে দেখে নি সীমা। তার কাছে তারা চাচাতো বোনরা ইদের সময় হাতে মেহেদী পরবার জন্য বা কোন উৎসব পালা পর্বণে সাজবার জন্য মুখিয়ে থাকতো। তার সেই মেজোচাচীর সুন্দর একটা নাম ছিলো। কি যেন নামটা ছিলো। হ্যাঁ মনে পড়েছে। ফিজা। এই ফিজা নাম্নী প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি না পেরানো বিহারি কলোনি থেকে আগত সেই বিধবা যুবতী তাদেরকে প্রথম বৃষ্টির পর মাটির সোঁদা গন্ধ নিতে শিখিয়েছে, দখিনা বাতাস মাখতে শিখিয়েছে,ঋতু পরিবর্তনের রং চিনিয়েছে জ্যোৎস্না মাখা শিখিয়ছে। সীমার থেকে একটু বড় সীমার আরেক চাচাতো বোন তার লেখা একটা কবিতা খাতা ও আবিষ্কার করেছিলো।আচ্ছা এমন একটা সংবেদনশীল মানুষের কেমন যে চশমখোর পিতা ছিলো কে জানে।নয়তো সীমার পয়তাল্লিশ বছর বয়সী দোজবরে মেজোচাচার সাথে নিজের ওমন ফুটফুটে পনের বছরের কিশোরী মেয়েটির বিয়ে কেউ দিতে পারে!সীমার ক্ষয়রোগী মেজোচাচাও তাকে নারীত্বের চরম পাওনা মানে একটা কন্যাশিশুর জননী করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। সবাই ভেবেছিলো আঠারো বছরের বিধবা ফিজার জীবন কচি শিশুকে বুকে নিয়ে হয়তো তাদের সংসারে বাঁদি গিরি করতে করতেই কেটে যাবে। হয়তো সেই ফিজা নাম্নী সেই বিধবা যুবতীর জীবনটা বেশির ভাগ একঘেয়েমি ও কিছু বৈচিত্র্য নিয়ে মসৃণভাবেই কেটে যেত। কিন্তু বাধ সাধলো একদিন। যেদিন সীমার বড় চাচীর ভাইয়ের বন্ধু চাকুরির সন্ধানে তাদের বাড়িতে আশ্রয় নিলো।সীমার বড় চাচা সেই সময় নামীদামি উকিল,খুবই প্রভাবশালী।তার হাতে পায়ে ধরলে বেকার বি.এ পাশ ছেলের যে একটা ঠিকানা হবেই সেটা আশা নিয়েই তাদের বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছিলো সেই লোক টা। তারপর অবশ্য চাকুরি ও বোধহয় হয়েছিলো সীমার বড় চাচার সুপারিশে।তারপর ও অনেক দিন লোক টা বাড়িতে থেকে গিয়েছিলো।শুধু একদিনের একটা দৃশ্য সীমার মাথায় সেই সাত বছর বয়স থেকে আজ অব্দি মাথায় গেঁথে আছে সেটা হলো লোকটা তার মেজোচাচীর রুক্ষ চুলের খোঁপায় গোলাপ ফুল গুঁজে দিচ্ছে। তারপর একদিন শোরগোলে খুব ভোরে তার ঘুম ভাঙলে সে দেখে বাড়িতে সব বড়দের মুখ থমথমে কারণ তাদের বাড়ির মেজোবৌ তিন বছরের কন্যা শিশুটি কে রেখে পালিয়ে গেছে। সেই থেকে সবার প্রিয় বাড়ির মেঝোবৌ হয়ে গেল একটা কলঙ্কিত নাগিন। তার নাম উচ্চারণ করাটা ও প্রায় সীমাদের সবার হারামের মতো হয়ে গেছিলো।সবার ঘৃণা করা দেখে বা সন্তানের জন্য মায়ের জন্য গতানুগতিক ত্যাগ না দেখে সে ও ফিজাকে মন থেকে নিষিদ্ধ করে রেখেছে। ছি!একটা মা কিভাবে তার তিন বছরের দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ফেলে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যায়। এতো এদের মতো মহিলাদের শরীরের ক্ষুধা থাকে যে সন্তানের ভবিষ্যত এভাবে ভাসিয়ে দেয় এরা। এদিকে সে একটা সন্তানের জন্য হেদিয়ে মরছে। এরকম মহিলাদের নরকে ও জায়গা হবে না। ভাবলে ঘৃণা হয় সে এমন একটা মহিলাকে একসময় খুব ভালোবাসতো। বিকেলে শুয়ে যুবতী সীমা ভাবছিলো আচ্ছা একবার যদি মাসুম তাকে বলে থেকে যাও সীমা,এই দেখো পুরানো সেই তোমার প্রেমিক মাসুম, তখন, তখন সে কি করবে? মাসুম তার জীবনের প্রেম।কই প্রযুক্তির এই যুগে সে ও তো কত পুরুষের মধ্যে প্রেমিক খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে কিন্তু খুঁজে বের করতে পেরেছি কি? তাদের কাছে গেলে নিজেকে শুধু শরীরসর্বস্ব বা যৌনতায় কাতর নারী মনে হয়। সেই আকাশে তুলো উড়াবার মতো অনুভূতি আসেই না যেটা মাসুমের সাথে থাকলে অনুভব হয়। এইসময় কতকগুলো পাগলা হাওয়া এসে ঘরে এসে সীমার শাড়ী রীতিমতো এলোমেলো করতে শুরু করলে সীমা জানালা বন্ধ করতে উঠতে গেলেই হঠাৎ মাসুমের আগমন হয় আর সীমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলে ওঠে , 'থাক বন্ধ করো না জানালা, '। সীমা মাসুমের হঠাৎ আগমনে একটু চমকে উঠলে ও খানিকটা নিজেকে সামলে নিয়েই বলে,'বৃষ্টি আসলো বলে,দামী কার্পেট যে বৃষ্টির পানি তে ভিজে যাবে,তাছাড়া এখন তো এসি ছেড়ে তো তুমি আরাম করবে কিছু ক্ষণ'। মাসুম,'থাক আজ আর এসি চালাবো না,আজ একটা কান্ড হয়েছে জানো,,দেখলাম ছিয়াশি বছরের বয়োবৃদ্দ এক লোক কে তার সাতাত্তর বছরের বৌ নিয়ে হাসপাতালে অনেক দৌড়াদৌড়ি করছে,তিন ছেলেমেয়ের একটা ও পাশে নেই। সীমা,'তুমি হাসপাতালে গিয়েছিল কেন?' মাসুম, 'ঐ একটা ব্যাপার, আর কি'। মাসুমের উত্তরেই সীমা বুঝে যায় যে মাসুম মূলত তাদের সন্তানের আশাতেই হাসপাতালে গিয়েছিলো,যেন যা দোষ তাদের যারই থাক না কেন, খুঁজে বের করে সঠিক চিকিৎসা করা যায়। এই নিয়ে নিত্যদিন তাদের খিটমিটি লেগেই ছিলো।মাসুম কোন ক্রমেই রাজী হচ্ছিলো না। হঠাৎ মাসুম বললো, 'তুমি তো আগে বৃষ্টিতে ভিজবার ওস্তাদ ছিলে,এখন ভিজো না কেন, 'চলো আজ বৃষ্টিতে ভিজি'। সীমার সেপারেশনের কথাটা আজ আর বলা হলো না। কিছুদিন পর আবার অন্তঃসত্ত্বা সীমা বারান্দায় গিয়ে দেখলো নয়নতারা গাছটা আজ আবার ও তার ফুলগুলো সহ ঝলমল করছে। এবার সে বুঝতে পারলো নয়নতারা গাছটির জীবনরহস্য।কিছুদিন আগের বৃষ্টির মাধ্যমে গাছটি নিজের প্রাণরস সঞ্চার করে ভুবন আলো করছে। হয়তো সেই সাথে সীমার এটাও ধারণা হলো ভালোবাসা নামক বৃষ্টি মাধ্যমে সে ও নিজের জীবনীশক্তি আবার ফিরে পেয়েছে আর এই ভালোবাসায় হয়তো ফিজাদের আসামাজিক খারাপ মা হওয়ার তকমা দিয়েছিলো, সন্তানকে ফেলে পৃথিবীর সব কলঙ্ক মেখে স্বর্গীয় এক অনুভূতি আস্বাদনের উৎসবে মাতিয়ে রেখেছিলো। হঠাৎ সীমার বুক তার মেজোচাচীর জন্য কান্নায় মোচড় দিয়ে উঠলো। মন থেকে সে তার মেজোচাচীর জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া চাইলো।


AUTHOR

জাবিন তাসনীম খান

প্রতিষ্ঠানঃ রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ বিভাগঃ ইংরেজি সেশনঃ ২০১৫-১৬

Comments


bottom of page