গল্পঃ ভালবাসি মা
- শময়িতা দিয়া
- May 8, 2023
- 4 min read

স্টেশনের পাশের হোটেলের সামনে দাড়ানো এক ৬ বছর বয়সী মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে নীরা। কি সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা। দেখেই নীরার তার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। নীরা কোনো দিনও মা হতে পারবে না বলেই হয়তো তার প্রতিটা বাচ্চার প্রতি এত মায়া। সে চায় তার সারাদিন এর সাথে হয়ে কেউ থাকুক। শফিক কাজে চলে গেলে তার বড় একা লাগে। যে দিন নীরা তার অনাগত ৫ মাসের সন্তান সহ সিড়ি থেকে পিছলে পড়ে গিয়েছিল। সে দিনই তার ৫ মাসের অনাগত বাচ্চার মৃত্যু হয়। এর পর থেকে নীরা অনেক চুপচাপ হয়ে যায়। কিছুদিন পরই ডাক্তার জানায় সে কোনো দিনও আর মা হতে পারবে না। এ
নীরা ও তার স্বামী শফিক বাচ্চাটাকে হোটেলের ভেতর খেতে খেতে দেখছিল। হঠাৎ ই নীর শফিক কে বলে উঠলো
- শফিক দেখো বাচ্চা টা!! সুন্দর না!!
- হুম সুন্দর ।
- আমি ওর কাছে একটু গেলাম।
বলেই নীর উঠে গেলো। শফিক তাকে কিছু বলতে চেয়েও বললো না।
নীর প্রান ভরে মেয়েটাকে দেখছে। একটা ময়লা ফ্রগ পড়া মেয়েটা হোটেলের বাহিরে দাড়িয়ে। চুলগুলো ঝুটি করা হলেও তা উস্কো খুস্কো চুল,তার চেহারায় কালচে ছাপ এটা প্রমান দিচ্ছে সে বড় অযত্নে বড় হয়েছে। তবুও মায়া ভরা মুখ। বাচ্চাটা খুব ক্লান্ত মুখ নিয়ে হোটেলের দিকে তাকিয়ে আছে। বাচ্চাটার সামনে গিয়ে নীরা বলে উঠলো
- তোমার নাম কি??
- আমার নাম কুলসুম।
- তুমি কোথায় থাকো?? আর এখানে দাড়িয়ে কি করছো?
- আমি ঐ ছাউনিডায় থাকি। আমার মা এ হোটেলে কাম করে।
- তুমি কি তোমার মায়ের জন্য অপেক্ষা করছো?
- না। আমি আমার মারে দেখার লাইগা দাড়াই আছি।
- ওহ। সকালে কিছু খেয়েছো?
- হয়।
- কি খেয়েছো??
মেয়েটা আর কিছু বললো না। নীরা তার উওর বুঝে নিল। তারপর বলল
- এখানে এসো। চুপটি করে বসো। আমি এখনি আসছি।
বলেই নীরা হোটেল থেকে এক প্যাকেট বিরিয়ানি দিয়ে বললো।
- খেয়ে নিও কেমন৷ আর তুমি প্রতিদিন এভাবে দাড়িয়ে থাকো??
- হয়।
- আচ্ছা এটা বাসায় গিয়ে খেয়ে নিও।
- আইচ্ছা।
নীরা মেয়েটার চলে যাওয়া দেখছে। ওর খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে প্রান ভরে আদর করতে। কিন্তু মেয়েটা অন্যকারো। কিন্তু নীরার মন তো মানে না।
সে বাসায় গিয়ে শফিক কে বলবে এবার একটা বাচ্চা এডপ্ট করতে। সে এভাবে একা আর পারবে না থাকতে।
চারদিকে কোলাহল। কুলসুম তার সৎ মা ও তার ছোট ভাইয়ের জন্য। সবটুকু বিরিয়ানি রেখে তার থেকে মাএ এক মুঠ বিরিয়ানি নিয়ে খেতে বসবে। তার আগেই মনে হলো। তার মা তাকে ঘরের সব কাজ সেরে নিতে বলেছিল। নইলে তার আজ সকালের মতো রাতেও ভাত জুটবে না। সে তার মায়ের কথামতো ঘরের সব কাজ সেরে ঘর মুছে। নিচে তার পাতে রাখা খাবারটা খেতে বসে গেলো।আজ বড্ড ক্লান্ত সে সারাদিন না খেয়ে এত কাজ করে প্রচন্ড ক্ষুধা পেটে।
কুলসুম সবে মাএ এক লোকমা খেয়েছে এর মধ্যেই তার সৎ মা রোজিনা হাজির হয়েছে। তার পাতে এ খাবার দেখে কুলসুমের মা এই ৬ বছরের বাচ্চাকে টেনে তুলে এক থাপ্পড় মারে। এতে কুলসুমের মুখ থেকে অর্ধ খাবার ছিটকে পড়ে।
এক পর্যায়ে তার মা এক লাঠি এনে মারতে থাকে একটার পর একটা মারে কুলসুম ক্লান্ত হয়ে মাটিতে শুয়ে রয়।
তার সৎ মা চিল্লাচিল্লি করতে থাকে আর বলতে থাকে।
- কই পাইলি এত ভালো খাবার৷ পাইছিস একা একা খাইতেছিস। আমার পোলাডা কি নাই??
তুই আমার পোলারে না দিয়া এ খাওন গিলতাছিলি????
অপর প্রান্ত থেকে কোনো উওর পাওয়া গেলো না৷ কুলসুম চুপচাপ মাটিতে শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ হয়ে গেছে ওর।
সৎ মা কিছুক্ষণ পা দিয়ে ধাক্কা দিতেই বুঝে যায় কুলসুম এ দুনিয়ায় আর নেই। শেষ বাড়িটায় তার শেষ রক্ষা হলো না। কুলসুমের মুখে সে শেষ একটা ডাক শুনেছিল তা খুব কিঞ্চিৎ হলেও শুনেছিল। সেটা হলো মা!!!
হয়তো সে কিছু বলতে চেয়েছিল।
এদিকে চারপাশে মারের আওয়াজ এবং রোজিনার চিল্লা চিল্লি তে আশেপাশের মানুষ এসে জড় হয়েছে। যখন মারছিল তখন ও মানুষ এসে পৌছায় নি। রোজিনা তাকিয়ে দেখে চারদিকে মানুষ তার দরজায় উকি দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ এর জন্য রোজিনা চুপ করে রয়!! হয়তো তার বিবেক এ টানা পড়েছে। আসলেই সে মেরে ফেলেছে???
এ দিকে বিছানায় থাকা ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে রোজিনা ভয়ে চুপটি করে ঘরে বসে রয়।
নীরা অনেক কস্টে শফিক কে রাজি করায় সে কুলসুমের মায়ের সাথে কথা বলে তাকে এ বাসায় আনবে। শফিক ও নীরা বের হয়। তারা পৌছে যায় সেই গলিতে থাকা ছাউনি তে। এত লোক আর ভিড় সমাগম। অনেক ঠেলে নীরা ও শফিক কুলসুম এর নিথর দেহ আবিষ্কার করে। নীরা কাঁদতে থাকে। সে যদি আজ তাকে বিরিয়ানি টা না দিতো এক বেলা না খেলেও মেয়েটা হয়তো বেঁচে থাকত!!! সে আর কখনো কাউকে আকড়ে ধরবে বাচতে চাইবে না। সে যাকেই আপন করে পেতে চাইবে সেই এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে।
পুলিশ আসে সব তদন্ত করে সেই এক প্যাকেট বিরিয়ানির পুরো অংশ সামনে এনে রোজিনা কে দেখিয়ে বলতে থাকে।
- মেয়েটা তোকে ভালোবাসত। যেটার জন্য মেরেছিস নে। এত ছোট একটা বাচ্চাকে কেউ এভাবে মারে???
সব কিছু শেষে একটা পাতায় ছোট করে লিখা "মা ভালোবাসি"
রোজিনা কাঁদতে থাকে। এ তার কিসের কান্না!!!
বিবেকের নাকি তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে সেটার!!!!!
কুলসুমের নিথর দেহ এখনো পড়ে আছে। রোজিনা তার মুখের দিকে সাহস করে তাকিয়ে ছিল একবার। কুলসুমের মুখ যেনো তাকে কিছু বলতে চায়???
কি বলতে চায় কুলসুম। রোজিনাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। রাস্তায় যেতে যেতে আকাশ থেকে যেনো ভেসে আসছে কুলসুমের অব্যক্ত কথা।
জানো মা আমি তোমারে আমার নিজের মায়ের মতো ভালোবাসতাম। আমার মা তো আমারে রাইখা চইলা গেছে। আমি তোমারে আকড়াই ধরবার চাইছিলাম। তোমার কোলে উঠতে খুব মন চাইতো। কিন্তু তুমি নিতা না। খুব বকতা কাম না করলে। জানো মা আমি সব কাম করে রাখতাম শুধু তোমার থেকে আদর পাওয়ার লাইগা। কিন্তু তুমি করতা না৷ এক বেলা না খাইলেও আমার কস্ট হইতো না মা, যদি আমারে তোমার বুকে ঠাই দিতা। মা জানো অনেক শখ হইতো তুমি আমারে আগলাই রাখবা আমারে অন্যের মায়েরা যেমন তাগো আদর করে খাওয়াই দেয় তুমিও দিবা!!! কিন্তু আমি ছোট থেইকা একাই ভাত খাইছি। তোমার মাঝে আমি আমার মরা মারে খুজতাম। কিন্তু পাই নাই মা৷ মা তো মা ই হয়। এখানে কি সৎ আর আপন মা বলতে কিছু হয়???মায়ের আদর পাওয়ার বড্ড লোভ আছিল আমার।
আইচ্ছা মা কও তো মা হইতে কি রক্তের টান লাগে??? পেটে ধরা ছাড়া কি মা হওন যায় না??? আদর পাওন যায় না!!! তয় কি মা আমিও অভাগী!!! যাও মা তোমার মুক্তি । আজ থেইকা তোমারে আর আমার মুখ দেখুন লাগবো না৷ আমি দুনিয়া ছাইড়া তোমারে ছাইড়া, ভাইরে ছাইড়া চইলা আইছি। ভালো থাইকো মা।
এ পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের জীবন গল্প একেক টা নাটক, মুভি কেউ হার মানাবে। মানুষ সহজে পাইলে হীরাকেও কয়লা ভাবে। রোজিনা এক ছোট্ট শিশুর অদম্য ভালোবাসা পেয়েও তাকে দূরে ঠেলেছে। এ দিকে নীরা এক বাচ্চার জন্য হাহাকার জীবন কাটায়।
কুলসুম তার সৎ মাকে যেমন এতটা ভালোবাসতো তেমন ই অনেক ছেলে মেয়ে তার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। জীবন এমন ই গোলক ধাধা। আমরা যা চাই তা পাই না, আবার যা পাই তার মূল্য দিতে জানি না।
সমাপ্ত।
AUTHOR
শবনম মোস্তারিন Gazipur government Mohila College. Class :12
Komentarze