top of page

গল্পঃ একাত্তরের জমসেদ

  • Writer: শময়িতা দিয়া
    শময়িতা দিয়া
  • May 8, 2023
  • 3 min read



এখনো মনে পড়ে সময়টা ১৯৭১। ঝম ঝম বৃষ্টি পড়ছে সারাটা বর্ষা জুড়ে। বসে আছি ১০ নং সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা অপারেশন ক্যাম্পে। ক্যাম্পের পাশের পিচ ঢালা রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে। বর্ষার বৃষ্টিতে রাস্তা চেনা দায়। রাস্তার ওপারে পাকবাহিনীর মজবুত প্রতিরক্ষা অবস্থান। হঠাৎ সাইরেন বেজে উঠলে অস্ত্র হাতে তাবুর বাইরে এসে দেখি মুক্তিযোদ্ধারা যার যার পজিশনে চলে গেছে। আমার সহযোদ্ধারা ইশারায় দেখালো কয়েকশ দূরে কতগুলো লোকের চঞ্চল ছায়া ক্যাম্প অভিমুখে আসছে। বোঝার উপায় নাম শত্রু না মিত্র। কাছাকাছি অবস্থায় আসতেই বোঝা গেল, চারজন খাটিয়ার মত কিছু একটা কাঁধে এগিয়ে আসছে। যাদের মধ্যে একজন খাটিয়ায় শায়িত রয়েছে। চারজনের একজন আমার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাহাবুদ্দিন। তখন মনে পড়ল, আমি শাহাবুদ্দিনকে শহরে পাঠিয়েছিলাম পাক সেনাদের ক্যাম্পটি রেকি করে আসতে। যাতে করে আমরা রাতের অন্ধকারে তা উড়িয়ে দিতে পারি। শাহাবুদ্দিন আমার সামনে খাটিয়ার শোয়া ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, "কমান্ডার, এই ছেলেটিকে এখনই হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও, ওর ঘটনা পরে বলছি।" দেখলাম বছর সাতেকের একটা ছেলের বুকটা গামছা দিয়ে বাঁধা। রক্ত চুইয়ে পড়ছে, বৃষ্টির পানি ও ছেলেটার বুকের রক্তে আমাদের ক্যাম্পের সামনের ছোট নালাটা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। শাহাবুদ্দিন বলল, "শহরে রেকি করতে যাওয়ার পর মুহূর্তেই পাক বাহিনীর টহলদার গাড়িসহ এসে আমাকে আটক করে থানা হাজতে নিয়ে যায়।" তারপর? "থানাহাজতে গিয়ে দেখি ভিতরে একটি সাত কি আট বছর বয়সের ছেলে বসে আছে।" আমাকে দেখেই বলল, "আহারে ! আপনেরেও ধইরা আইনছে, আপনেরে দেইখা মনে হচ্ছে আপনি জয় বাংলার লোক, মুক্তিযোদ্ধা। কপাল খারাপ ভাই। আপনেরে মনে হয় পাকিস্তানের বাহিনী গুলি কইরা মাইরা ফেলবো।" ওর কথা শুনে আমার চরম বিরক্তি এসে গেল। এমনিতেই ধরা পড়েছি, রেগে গিয়ে বললাম, "এই ব্যাটা, এত প্যাচাল পারিস কেন? তুই কে?" "হামার নাম জামশেদ। শহরে সবাই হমারে জামশেদ চোর বইলাই জানে। আইজকা বাজারে একজনের পকেট মাইতে গিয়া পাবলিকের হাতে ধরা পড়ছি, তারপর পুলিশ এই হাজতে নিয়া আইলো। তবে আপনি চিন্তা কইরেন না, দরকার হইলে হামার জীবন বাজি দিয়া আপনারে বাঁচামু। আপনি দেশের জন্য যুদ্ধ করতাছেন, আপনি মুক্তিযোদ্ধা। আপনি হামাগোর মাথার মুকুট। হামার মত পকেটমারের জীবনের কি দাম আছে কন তো দেখি।" জানো কমান্ডার, এই কথাগুলো বলেই সে তার পরনের, শার্টের কলারের কোনা থেকে একটা ধারালো ব্লেডের টুকরা বের করল , তারপর কোন কিছু বোঝার আগেই জমশেদ ওটা দিয়ে তার বুকের এক পাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত ভাজ করে টাল মারলো l ধারালো ব্লেডের টানে বুকের মাংস কেটে ঝরঝর করে রক্ত বেরোতে শুরু করল l হাজতের পুলিশ একটু দূরে দাঁড়ানো, জমশেদ ওদের মনোযোগ আকর্ষণ করে চিৎকার করে উঠল, "রক্ত! রক্ত!" পুলিশ দেখল ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। এই অবস্থায় ভেবাচেকা খেয়ে পুলিশ তাড়াতাড়ি এসে হাজত খুলল। জামশেদ আমাকে বলল, "ভাই হাইজত খোলা, হেবার আপনে পালাইয়া যান।" আমি এক হাতে জামশেদকে ধরে, অপর হাতে পুলিশকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ওকে নিয়ে থানার বাইরে এলাম। তারপর পাশের গ্রামে ঢুকে পড়লাম, গ্রামের লোকজন এগিয়ে এলো। একজন লোক তার কোমরের গামছা খুলে তার বুকটা বেঁধে দিলো। যে লোকটা গামছা দিয়ে বুক বেঁধে দিল সে বলল, "ভাই, হামার নাম মনোয়ার, হার সবাই শহরে হামারে মনোয়ার ডাকাত বইলা জানে। হামি এই শহরে ডাকাইতদের সর্দার। এই ছোকরাটা আমার ভিতর মুক্তিযোদ্ধাদের এবং দেশের জন্য এক চেতনা আইনা দিয়েছে। কেডায় পারে নিজের বুক কাইটা দেশের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করতে? কত বড় আত্মত্যাগ? হেই অঞ্চলে হামার ৩০ জন সাগরেদ আছে। আইজ থাইকা হামরা সবাই ডাকাতি ছাইড়া দিয়া হালাল পথে দেশে থাইকা রোজগার করমু।" সেইদিন থেকে জামশেদ আর তার দল দেশের কথা ভেবে হালাল পথে রোজগার করার প্রতিজ্ঞা করে। দেশ স্বাধীন হয়, কেটে যায় ৫১ বছর বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল, আর তার রাজনীতিবিদরা অতি ডিজিটাল। একাত্তরের সেই ছোট্ট জমশেদকে আজ তার পরিবারের হাল ধরতে বিভিন্ন কাজ করতে হচ্ছে। সে নানা জিনিস বিক্রি করে বিভিন্ন সময়ে, সারা বছর ধরে। এমনই একটি স্বাধীনতা দিবসেই জামশেদ পতাকা বিক্রি জন্য বেরোয় l তার সাথে তথাকথিত এক রাজনীতিবিদের দেখা হয়, যারা রাতে জনগণের ভোট চুরি করে, বিদেশে টাকা পাচার করে, দিনের বেলা টিএসসি-তে এসে জয় বাংলা বলে ঝড় তোলে। ট্রাফিক সিগন্যাল পড়ায় গুলশানের রাস্তায় গাড়ি গুলো দন্ডায়মান দেখে জমশেদ এক গাড়ির কাছে গিয়ে সরল মনে বলে, "আইজকা মহান স্বাধীনতা দিবইস, একটা পতাকা কিনবেন স্যার"? রাজনীতিবিদ উত্তরে বলে, "তোদের জ্বালায় রাস্তায় দাঁড়ানো দায়, আজ পান বেচিস তো কাল পতাকা, কি বেচিস না বল?" স্বাধীনতাযুদ্ধের শক্তিতে উজ্জীবিত জমশেদ বলে, "ভালা প্রশ্ন করছেন স্যার, ১৯৭১ থাইকা আইজ পর্যন্ত মেলা জিনিস বেচচি, কিন্তু দেশটারে বেচাই নাই।"


AUTHOR

আশুরা তাবাসসুম আরশি HSC 2022 Cantonment Public School and College, Rangpur

Comments


bottom of page