top of page

গল্প: আমার অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী

  • Writer: শময়িতা দিয়া
    শময়িতা দিয়া
  • May 8, 2023
  • 4 min read

আমার নাম ইতি। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক আমি। আমার বাড়ি লক্ষনখোলা। এটি নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার অধিভুক্ত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনেও অনেকের অবদান রয়েছে। স্বাধীনতার সময়ও আমাদের গ্রামে নানা ঘটনা ঘটে। স্বাধীনতা যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ নিজের চোখে না দেখলেও বাবা-মা,পরিবারের মানুষদের কাছ থেকে যা জানতে পেরেছি বা শুনতে পেরেছি তাতে মনে হয় নিজের চোখের সামনে সেসব দৃশ্য ভেসে ওঠে। আমার পরিবারের একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল, সে হচ্ছে আমার চাচা। তার নাম শাহ আলম। তিনি ছাত্র জীবনে দেশের উপর পাকিস্তানিদের বর্বরতা দেখে ছাত্র জীবনের মধ্যেই সে দেশ স্বাধীন করার তাগিদ অনুভব করে। আমাদের অঞ্চলের বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেয়। আমাদের গ্রামে বীর প্রতীক আব্দুল কুদ্দুস মুক্তিবাহিনী গঠন করে। সেই মুক্তি বাহিনীর দলকে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানো হয়েছিল এবং তাতে আমার চাচা শাহ আলম বাড়ির কোনো সদস্যকে না বলে তাদের সাথে চলে যায়। প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তিনি ১০ নং সেক্টর এর অধীনে কর্মরত ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে জানতে পেরে আমাদের অঞ্চলের কিছু রাজাকার আমাদের বাড়ির উপর কুনজর দেয়। প্রথমে তারা আমাদের বাড়ির পালিত গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি লুন্ঠন করে নিয়ে যায় এবং মিলিটারিদের হুমকি দিয়ে যায়। এই অবস্থায় পরিবারের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আমার দাদী গভীর রাতে সবকিছু ফেলে রেখে আমার বাবা ও ফুফুদের নিয়ে পালিয়ে যায়। তাদের পালিয়ে যাওয়া দেখে আমাদের কিছু প্রতিবেশীও তাদের সাথে রওনা হয়। আমাদের অঞ্চলের দক্ষিণ দিকে কলাগাছিয়া নামক গ্রামে এক দুসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এদিকে রাজাকাররা কয়েকজন মিলিটারিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে কাউকে না দেখতে পেয়ে বাড়ি-ঘরে ভাঙচুর ও লুটতরাজ করে সবকিছু নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমার চাচা পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করতে আসে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে দেখে যে বাড়িতে কেউ নেই, বাড়িঘর ভেঙে চুরে পড়ে আছে। তাকে বাড়ি আসতে দেখে ফেলে একজন রাজাকার। রাজাকার তার হাতে থাকা রাইফেল নিয়ে তার কিছু নেয় কিন্তু দূর থেকে আমার চাচা তাকে দেখতে পেয়ে সে আমাদের বাড়ির পিছনে জঙ্গলের দিকে ছুটে যায় তার পেছন পেছন রাজাকারটি যায়। যখন আমার চাচা গভীর জঙ্গলে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকে তখন রাজাকার তার চোখের সামনে এসে আমার চাচাকে তার হাতে থাকার রাইফেল দিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু আমার চাচা নিজের আত্মরক্ষার জন্য রাজাকারকে মাটিতে ফেলে তার হাতে থাকা ডেগার দিয়ে তাকে গলায় আঘাত করে তাতে তার শ্বাসনালী কেটে যায় এবং সেই রাজাকার মারা যায়। গভীর জঙ্গল থেকে আমার চাচা যখন বেরিয়ে আসে তখন সে অন্যান্য রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে যায়। তখন রাজাকাররা তাকিয়ে ধরে নিয়ে এক রাজাকারের বাড়িতে নিয়ে তার উপর নির্মমভাবে অত্যাচার করে। রাজাকাররা পরিকল্পনা করে যে তাকে পরেরদিন সকালে মিলিটারিদের ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। আমার চাচাকে তারা একটি অন্ধকার ঘরের ভিতরে আটকে রেখেছিল। এক পর্যায়ে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। মধ্যরাতে সে যখন জ্ঞান ফিরে পায় তখন সে অনুভব করে তাকে কেউ একজন আস্তে আস্তে ডাকছে। সে চোখ খুলে উঠে বসে খেয়াল করে এই ভদ্র মহিলা হচ্ছে মির্জা বাড়ির দাদি। এই শুনে দাদি তাকে হাত-পা থেকে রশি ছুঁটিয়ে দিয়ে বলছে তাকে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে।সে যখন বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে কোনো রকম পালিয়ে বের হয় তখন সে দৌড়াতে দৌড়াতে এক জায়গায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে আবার অজ্ঞান হয়ে যায়। পরের দিন সকালে সেই যখন জ্ঞান ফিরে পায় তখন সে চেয়ে দেখে সে আমাদের গ্রামের লক্ষনখোলা কবরস্থান সেখানে পড়ে আছে। সে উঠে বসে, সে দেখে একটি লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে লক্ষ্য করে দেখে সেটা জয়নাল পাগলা। জয়নাল পাগলা কবরস্থানের ভেতরে এক ভাঙ্গা ঘরে থাকে। সেই সন্ন্যাস জীবন করে। সে আমার চাচাকে তার ঘরে নিয়ে যায়। তার ঘর থেকে একটি কাপড় ভিজিয়ে সে আমার চাচার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে দেয়। তারপর সে তার ঘরে থাকা মুড়ি, গুড় ও পানি আমার চাচাকে খেতে দেয় এবং তার খাওয়ার পর তাকে তা ঘরে রেখে এসে বাইরে চলে যায়। আর আমার চাচাকে বলে যে সে যেন তার না আশা পর্যন্ত ঘরে বাইরে বের না হয়। এই বলে জয়নাল পাগলা বাইরে চলে যায়। আমার চাচা জয়নাল পাতলা ঘরের মধ্যেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর তার ঘুম ভাঙলেই সেই অনুভব করে দুপুর হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই জয়নাল পাগলা এসে হাজির হয় সে আমার চাচাকে পাউরুটি ও কলা দিয়ে বলে যে এটা আজ দুপুরে খেয়ে নাও। তোমার সাথে লোকের খবর দিয়েছি, রাত্রে বেলা তোমার সহযোদ্ধারা এসে ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। মধ্যরাতে আমার চাচার সহযোদ্ধারা করিম, মোতালেব, আনিস, মুন্সি, রিয়াজ ভাই এসে তাকে তাদের মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে নিয়ে যায় সেখানে নিয়ে তাকে সেবা শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তোলে। এক সপ্তাহের মধ্যেই সে সুস্থ হয়ে যায়। পরবর্তীতে সে তার সহযোদ্ধার সঙ্গে সেই যুদ্ধে ফিরে যায় যুদ্ধের। শেষ দিকে আমার চাচা আমাদের অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে চলে যায়। যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা লাভের পর তার সহযোদ্ধাদের সাথে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দিয়ে তার বাড়িতে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরে আসে। সে দেখে তার পরিবার ও প্রতিবেশীরাও কলাগাছিয়া থেকে ফিরে এসেছে।সকলে নিজ বাড়িতে ফিরে আসার পর আস্তে আস্তে বাড়ি ঠিক করে। আমাদের অঞ্চলের মানুষের কার কি ক্ষতি হয়েছে তা দেখতে গিয়ে আমার চাচা জানতে পারে জয়নাল পাগলা আর নেই। জয়নাল পাগলা যে আমার চাচাকে ও তার সহযোদ্ধা মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পের সদস্যদের সাহায্য করেছে তা জানতে পেরে রাজাকাররা মিলিটারিদের মাধ্যমে জয়নাল পাগলা কেও শেষ করে ফেলে, আমার চাচা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন সে কষ্ট পেয়েছিল যে তার কারনে জয়নাল পাগলাকে হত্যা করা হয়েছিল। আমাদের অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ঘটনা ঘটেছিল তা সত্যিই অবিস্মরনীয়।


AUTHOR

Name : Sabiha Shubnam. Narayanganj College. Class :12.

Comentários


bottom of page