BANGLA STORY: জীবনের গল্প
- শময়িতা দিয়া
- May 8, 2023
- 5 min read

রাশেদ সাহেব অফিস থেকে এসে কফি খাচ্ছেন। এই সপ্তাহে প্রচুর চাপ, সামনে আবার ছোট মেয়ে রাহার জন্মদিন। কিছু তো একটা করতেই হবে না হলে অভিমানী মেয়ে খুব কষ্ট পাবে।
কি গো? কি ভাবছো। পিছন থেকে তার স্ত্রী এলিনা সুলতানা বলন ।। তেমন কিছু না। এই অফিসের চাপ নিত্যনতুন ঝামেলা এসবই ভাবছিলাম।
কফি তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ও হ্যাঁ, খেয়ালই করিনি।
বাবা ও বাবা। আমার জন্য কি এনেছো। রাহা বলল।
রাশেদ সাহেব বলল, সরি
মামনি। আজকে কিছু আনতে পারিনি অন্যদিন আনবো কেমন।
যেই এই কথা বলেছে অমনি রাহা গাল ফুলিয়ে আছে। বাবার সাথে কথাই বলছে না। কি যে রাগ মেয়ের তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না ।
মেয়েটির সাথে এমন মজা না করলেও পারতে, তুমি তো জানোই ও কত অভিমানী তাও কেন বারবার এই কথা ভুলে যাও। এলিনা সুলতানা বলল।
আমি তো এনেছি ওর জন্য চকলেট।
তাহলে দিয়ে দাও কেন শুধু শুধু মজা করছ।
মামনি, আর রাগ করে থেকো না। এই নাও তোমার প্রিয় চকলেট।
বাবার দিকে তাকাচ্ছেই না রাহা। এখনো ভার অভিমান রয়েই গেছে। ছোট থেকে অনেক আদরে মানুষ হয়েছে। বড়
মেয়ে রাহির মত শান্ত শিষ্ট রাহা নয়। ও হ্যাঁ, এদের পরিচয় আপনাদের দেয়া হয়নি। রাশেদ সাহেব আর এলিনা সুলতানা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। বিয়ের
তিন বছর পর তাদের কোল আলো করে সন্তান আসে। রাহি ও রাহা তাদের দুই মেয়ে। রাহি অনার্স প্রথম বর্ষের
শিক্ষার্থী। রাহা ক্লাস ফাইভে পড়ে। আবার চলে আসি মূল গল্পে-
অনেকক্ষণ ধরে বোঝানোর পর ছোটমেয়ে রাহা বাবার থেকে চকলেট টি নেয়।
মাগো কেন এত রাগ করিস এই বৃদ্ধ বাবার উপর।
আবার ভূমি আমাকে তুই করে বলছো। কতবার না বলেছি এভাবে ডাকবে না।
ঠিক আছে মা। আর তোমাকে তুই করে বলবো না। কিছুক্ষণ পর বড় মেয়ে রাহি বাসায় ফিরল। তার বিশ্ববিদ্যালয় বাসা থেকে খানিকটা দূরে। তবুও রফিক সাহেব তাকে
হোস্টেলে দেননি। মেয়েকে নিয়ে বড় চিন্তা ভার। মা ও মা, খাবার দাও বড্ড খিদে পেয়েছে। রাহি বললো।
একটু অপেক্ষা করো, দিচ্ছি।
এলিনা সুলতানা অনেক যত্নে মেয়ের জন্য খাবার নিয়ে এলো। বড় মেয়ে অনেক লক্ষ্মী যা দেয় তাই হাসিমুখে খেয়ে
নেয়। আজকেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
রাহা খেতে আসো মা। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। বাবাও খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। না, না আমি এখন ড্রয়িং করছি পরে খাবো।
এভাবে জেদ করেনা মা। তুমি খাওয়া শেষ করে ড্রইং কর। এখন লক্ষী মা আমার খেয়ে যাও।
তুমি আগে বাবাকে খাবার দাও। তারপর এসে আমাকে খাইয়ে দিও।
রাহা অনেক জেদি হলেও তার বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। আর বাবাও মেয়েঅন্ত প্রাণ । এভাবেই চলছিল তাদের সুখের সংসার। প্রতি দিনের ব্যস্ততা আর খুনসুটি মিলে দিনগুলো ভালোই চলছিল হঠাৎই এক
দমকা হাওয়া এসে সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে গেল।
"একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি, লাল ফ্রক পরা ১১ বছর বয়সি রাহা নামের ছোট্ট একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে। আনুমানিক
সন্ধ্যা ছয় টার পর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোন সহৃদয়বান ব্যক্তি যদি তাকে খুঁজে পায় তাহলে
নিজের নাম্বারে যোগাযোগ করুন। " রাশেদ সাহেব পাগল প্রায়। তাকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউশনে রাখা হয়েছে।
রাহি বিয়ে করে স্বশুর বাড়ি চলে গিয়েছে কিন্তু স্বামীর অত্যাচার ক্রমশ বেড়েই চলছে। এলিনা সুলতানা নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছে। আত্মহত্যা হারাম না হলে হয়তো করেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেত। জীবন কখন কি মোড় নেয় বলা মুশকিল। চলুন পুরো ঘটনা
জেনে আসা যাক।
তাদের জীবনের সবকিছু খুব সুন্দর চলছিল। এরমধ্যে রাহির জন্য অনেক সম্বন্ধ আসতে লাগলো। রাশেদ সাহেবও খুব
উদগ্রীব ছিল মেয়েকে বিয়ে দিবে বলে। অনেক দেখাশোনার পর একজনকে তার খুব ভালো লাগে। তিনি মনে মনে ঠিক করে এই ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবেন। তবুও একবার মেয়ের মতামত নিতে চান।
রাহি, একবার শুনে যাও না মা। কি বলছো বাবা। তাড়াতাড়ি বল কালকে আমার পরীক্ষা আছে।
এবার তো জীবনের পরীক্ষায় পাস করতে হবে মা।
কি যে বলো বাবা। লজ্জার রাহির মুখ লাল হয়ে গেছে।
শোন মা, কালকে যে ছেলেটি এসেছিল তাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। তোমার কি এই ছেলেকে সচ্ছন্দ হয়েছে? কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে রাহি বলল,
বাবা, তোমার পছন্দের উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। তুমি যা করবে তাতে আমার ভালোই হবে।
তুমি সব ভেবেচিন্তে এই কথা বলছো তো রাহি? ঠিক আছে। আমি বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলব ইনশাল্লাহ।
জি. বাবা।
১৫ দিন পরের কথা -
আপু, তুমি আজকে চলে যাচ্ছো। আমি একা একা থাকবো কি করে? আমার যে খুব কষ্ট হবে। ধুর বোকা মেয়ে। আমি তো মাঝে মাঝেই আসবো।
তবুও, আগের মতো তো আর একসাথে থাকা হবে না। খুনসুটি, অভিমান কিছুই করা হবে না। কষ্ট পাস না বোন।
কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করছিল।
বর এসেছে, গেটে চল সবাই। রাহির বাস্তবী ভিন্নি বলল।
টাকা ছাড়া বউ পাবে না।
কিসের টাকা? গেট ছাড়ো তাড়াতাড়ি। বরের ভাই একটু রাগী রে ।
ধুমধাম করে রাহির বিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে গেল। সে চলে গেল শশুর বাড়িতে। ফেলে গেল তার শৈশবের স্মৃতি আর
পরিবারের সকলকে। নতুন পরিবেশ আর অচেনা মানুষদের আপন করতে। ব্রাহির বিয়ের একমাস পূর্ণ হল। কাল রাহার জন্মদিন। সেই জন্য রাহি বিয়ের পর প্রথম বার বাপের বাড়ি এসেছে।
রাহি আপু, তুমি এতদিন আসনি কেন?
বোন আমি একটু ব্যস্ত দিলাম।
তোমার সাথে কথাই বলবো না। তুমি চলে যাও।
এভাবে রাগ করে না বোনটি। এরপর থেকে রোজ আসবো।
সত্যি বলছো আপু?
আমি কি তোকে মিথ্যা কথা বলতে পারি?
আমার সোনা আপুনি।
রাশেদ সাহেব এসে বলল, মা রে কেমন আছো? শশুর বাড়ির সবাই তোমাকে আপন করে নিয়েছে তো? কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাহী বলল, বাবা ভালো আছি আমি। তোমাদের কথা বড্ড বেশি মনে পড়ে। আজকে অন্য কথা থাক বাবা।
রাশেদ সাহেব কিছুটা সন্দেহ করল। ভাবলো মেয়ে শশুর বাড়িতে ভালো আছে তো? গভীর ভাবনায় ডুবে গেল।
বাড়িতে রাহার জন্মদিনের প্রস্তুতি চলছে। এলিনা সুলতানা নানান পদের খাবার রান্না করেছে, রাহি সারা বাড়ি খুব
সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছে। যেন মনে হচ্ছে বিয়ের আযোজন চলছে।
হ্যালো রাশেদ সাহেব বলছেন। জি বলছি। আপনি কে?
আমি আপনার অফিস থেকে বলছি। অফিসে গন্ডগোল লেগেছ, আপনি দ্রুত আসুন।
জি আসছি।
বেশি সময় নেই দ্রুত করুন।
তাড়াহুড়ো করে রাহাকে না জানিয়ে রাশেদ সাহেব বেরিয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে। মা ও মা বাবা কোথায়?
তোমার বাবা একটু অফিসে গিয়েছে চলে আসবে।
আজকে আমার জন্মদিন বাবা তবুও চলে গেল। মন খারাপ করিও না। বাবা তো কাজে গিয়েছে।
সন্ধ্যের মধ্যে সকল মেহমান চলে আসলো। কিন্তু রাহার বাবা এখনো আসলো না। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়ে গেল তবুও
রাহার বাবা এলো।
ইস বাবা তো এখনো এলো না। তাহলে কি আমার জন্মদিন আতাকে হবে না।
বাবা চলে আসবে বোন এখনো এলো না, আমার জন্মদিন আর হবেনা।
রাগ করিস না সোনা বোনটি আমার।
আমি নিজেই বাবাকে খুঁজে আনব।
এই কথা বলেই এক দৌড়ে বাড়ির বাহিরে চলে গেল রাজা। বোন, এই বোন থাম। একা যাস না।
মা, মা দেখো বোন একাই চলে গেল বাহিরে।
রাহি ও এলিনা সুলতানা বাহিরে গেল রাহাকে খুঁয়াতে। চারিদিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও রাহাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
এই দিকে রাশেদ সাহেবেরও কোনো খোঁজ নেই।
মা কিছু খেয়ে নাও, আর কতক্ষণ না খেয়ে থাকবে।
আমার গলা দিয়ে কিছু নামবে না তুই খেয়ে নে। না মা আমিও কিছু খেতে পারব না।
আমার সুখের সংসারে কার যে কুনজর পরল। দিনদুয়েক পর রাশেদ সাহেব বাড়িতে ফিরে এলেন।
রাহা মামনি, দেখো বাবা বাড়িতে ফিরে এসেছি।
তুমি এসেছ, বাবা। রাহি খুব করুন স্বরে বলল।
কি হয়েছে? তোমাদের এত বিষণ্ন দেখাচ্ছে কেন? বাবা ........ রাহাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কি বলছো এসব? নিশ্চয়ই সে লুকিয়ে আছে বাবাকে ভয় দেখাবে বলে। না বাবা আমি মিথ্যা কেন বলব। এর জন্মদিনের দিন তুমি দেরি করছিলে বলে ও তোমাকে খুঁজতে বের হয়েছিল।
আর ফিরে আসেনি। না এটা হতে পারে না। রায় মামনি আমাকে ফাঁকি দিয়ে কোথাও যেতে পারে না।
রাশেদ সাহের ক্রমশ চুপচাপ হয়ে গেলেন। ঠিক মত খায় না, অফিসে যায় না, কারো সাথে কথাও বলে না।
অনাদিকে রাহিও শ্বশুরবাড়িতে ভালো নেই। শাশুড়ি, স্বামীর গালমন্দ আর চর থাপ্পর খেয়ে তার দিন অতিবাহিত
হচ্ছে। খেয়ে নাও, রাহির বাবা। কি হলো সাড়া দিচ্ছো না কেন?
যেখানে আমার মেয়ে নেই আমিও থাকবো না। চলে যাব, চলে যাব। এই নিঠুর পৃথিবী আমার জন্য নয়।
ক্রমশ রাশেদ সাহেব আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছেন।
হাতে ছুরি নিয়ে বলছেন, কেউ আমার কাছে আসবেনা। আমি নিজেকে শেষ করে ফেলব।
তুমি এবার থামো রাহির বাবা।
কে তুমি? চলে যাও সামনে থেকে। এর পরের কাহিনী সবই আমাদের জানা।
রাশেদ সাহেব চলে গেলেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউশনে। এলিনা সুলতানা একা হয়ে গেলেন বাড়িতে। রাহি তার জীবনে সুখ খুঁজে পেল না। রাহার কোন খোঁজ পাওয়া গেল না।
গল্পটি অন্যরকমও হতে পারতো। কিন্তু কল্পতরু সুখের
সন্ধানে থাকা চারটি মানুষের গন্তব্য আলাদা করে দিলেন।
কল্পনা বাস্তবের চেয়েও সুন্দর। বাস্তবিক গল্পে কেউ জেতে কেউ হেরে যায়। হেরে যাওয়া গল্পগুলো থেকে যায় স্মৃতির অগোচরে। জীবনের গল্প গুলো জীবনের মত সুন্দর ও ভয়ানক।
AUTHOR
Nushrat Jahan mohima
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman maritime University, Bangladesh
Hons 2nd year
Comentários